০২। কুরআন শরীফ অনুবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
অনুবাদ বা ভাষান্তর এমনিতেই একটি জটিল বিষয়। কুরআনের মতো একটি আসমানী গ্রন্থের বেপারে জটিলতার সাথে স্পর্শকাতরতার বিষয়টিও জড়িত। মানুষের তৈরী গ্রন্থের বক্তার কথার হুবহু ভাষান্তর না হলে তেমন কি-ই বা আসে যায়। বড়জোর বলা যায় অনুবাদক মূল লেখকের কথাটার সাথে যথাযথ ইনসাফ করতে পারেননি, কিন্তু কুরআনের ক্ষেত্রে বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে অনুবাদের একটু হেরফের হলে স্বয়ং আল্লাহ তা'আলার কতাই বিতর্কিত হয়ে পরার আশংকা দেখা দেয়। এসব কারণেই মুসলমানদের মাঝে কেউই এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কুরআনের অনুবাদের ঝুঁকি নিতে চায়নি। এমনকি বিগত শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মধ্য এশিয়ার আলেমরা ফতুয়ার মাধ্যমে তাতারী ভাষায় কুরআনের যাবতীয় অনুবাদ প্রদেষ্টাকে বন্দ করে রাখেন। আফ্রিকা মহাদেশে বিশেষ করে নাইজেরিয়া ও নাইজারে হাউসা হচ্ছে আরবীর পর সর্বাধিক সমৃদ্ধ ভাষা। এই ভাষার আলেমরা দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাদের ভাষায় কুরআনের অনুবাদকে এই বলে বন্ধ করে রাখেন যে, এতে কুরআনের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। এই মহাদেশের কেমেরুন রাজ্যের সুলতান সাইয়িদ নিজেও আলেমদের প্রবল বিরোধিতার কারণে বামুম ভাষায় কুরআন অনুবাদ কাজ থেকে ফিরে আসে। মুসলিম দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠ বিদ্ধাপীঠ আল আজহার বিসবিদ্ধালয়ের ফতুয়া বোর্ডও তো এই সেদিন পর্যন্ত কুরআনের যাবতীয় অনুবাদকর্মের বিরোধিতা করে আসছিল।
১৯২৬ সালে তুরস্কে ওসমানী খেলাফত বিলুপ্তির পর তুর্কি ভাষায় কুরআন অনুবাদ প্রচেষ্টার তারা বিরুধিতা করেন। কুরআনের ইংরেজি অনুবাদক নও মুসলিম মার্মাডিউক পীকথল যখন কুরআনের অনুবাদ করার উদ্ধোগ গ্রহন করেন তখন হায়দারাবাদের শাসক নিজাম তাকে সর্বাত্মক সহযুগিতা দিলেও আল আজহার কর্তিপক্ষ এ উদ্দুগের তীব্র বিরুধিতা করেন। অবস্য দীর্ঘদিন পর হলেও মক্কাভিত্তিক মুসলিম সংস্থা রাবেতা আল আলামে ইসলামী আয়োজিত বিশ্বের সর্বমতের ওলামা কুরআন অনুবাদের একটি ঘোষণাপত্রে সই করে এ পথের যাবতীয় বাধা অপসারণ করেন, কিন্তু এটা তো ১৯৮১ সালের কথা, মাত্র সেদিনের ঘটনা। অবস্য এরও বহু আগে ইংরেজ লেখক জর্জ সেল কুরআনের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। ১৭৩৪ সালে এই অনুবাদ কর্মটির প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়।
১৭৬৪ সালে তার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ মুদ্রিত হয়। ১৮২৫ সালে এটি পুনর্মুদ্রিত হয়।
আমরা যদি আজ কুরআনের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে, কুরআন অনুবাদের এই মুবারক কাজটি স্বয়ং তাঁর হাতেই শুরু হয়েছে যার ওপর এই কুরআন নাজিল হয়েছে। আমরা জানি, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম তাঁর আন্দোলনের এক পর্যায়ে তত্কালীন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে দূত পাঠাতেন। তাঁর পাঠানো এসব চিঠিতে অবশ্যই একাধিক কুরআনের আয়াত লেখা থাকত। যেসব দেশের রাজা বাদশাহরা আরবি বুজতেন না রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম এর দূত তাদের কাছে গোটা চিঠির সাথে সেসব আয়াতের তরজমাও পেশ করতেন। একারণেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট রাষ্ট্র নায়ক প্রিয় নবী যে দূতকে যে দেশে পাঠাতেন তাকে আগেই সে দেশের ভাষা শিখতে বলতেন। অধিকাংশ নতুন এলাকায় তিনি পারদর্শী দোভাশিও পাঠাতেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে সাদ বলেছেন আল্লাহর নবী সাধারণত সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষায় অভিজ্ঞ লোকদেরই দূত করে পাঠাতেন। ইবনে সাদ আরো বলেছেন যে, প্রিয়নবী তার বেক্তিগত সহকারী ওহি লেখক হজরত যায়েদ বিন সাবেতকে সিরিয়ান ও হিব্রু ভাষা শেখার আদেশ দিয়েছিলেন। তাছাড়া আমির বিন ওমাইয়া যে আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসির কাছে লেখা রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম) এর আরবি চিঠিকে আমহারিক ভাষায় অনুবাদ করেছেন তারও একাধিক প্রমান ইতিহাস গ্রন্থে মজুদ রয়েছে। রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম) এর সময়ের কুরআনের এসব আংশিক অনুবাদ ছিল অনেকটা মুখে মুখে। কোথায়ও লিখিত আকারে এগুলুকে কুরআনের আয়াতের অনুবাদ হিসেবে কেও সংরক্ষণ করেনি। পরবর্তী সময়ে যখন কুরআনের বাণী নিয়ে আল্লাহর রসুলের ঝাঁবাজ সাথীরা দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়লেন তখন এর প্রয়জনীয়তা তীব্র হয়ে দেখা দিল। কুরআনের বিষয়বস্তু ও ভাষাশৈলীর স্পর্শকাতরতার কারণে কুরআনের গবেষকরা প্রথম দিকে নানান রকম আপত্তি উত্থাপন করলেও শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষায় ছড়িয়ে পড়ল। বাইরের পরিমন্ডলে এসে সম্ভবত ফার্সি ভাষায়ই সর্বপ্রথম কুরআন অনুদিত হয়েছে। প্রিয় নবীর ইন্তেকালের প্রায় ৩৫০ বছর পর ইরানের শাসানি বাদশাহ আবু সালেহ মনসুর বিন নুহ কুরআনের পূর্ণাঙ্গ ফার্সি অনুবাদ করেন। কুরআনের ফার্সি অনুবাদের এই বিরল কাজের পাশাপাশি তিনি মুসলিম ইতিহাসের প্রথম পূর্ণাঙ্গ তাফসীর গ্রন্থ ইমাম মোহাম্মদ বিন জারীর আত তাবারীর ৪০ খন্ডে সমাপ্ত বিশাল আরবী 'তাফসীর জামেউল বয়ান আত তাওয়িলুল কুরআন'-এর ফার্সি অনুবাদ করেন। আমাদের এই উপমহাদেশে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মহাদ্দেসে দেহলভী কুরআনের যে ফার্সি অনুবাদ করেছেন তা ছিল আরো ৮০০ বছর পরের ঘটনা। প্রায় একই সময়ে অর্থাৎ ১৭৭৬ সালে শাহ রফিউদ্দিন ও ১৭৮০ সালে শাহ আব্দুল কাদের কুরআনের উর্দু অনুবাদ করেন।
বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের কাজটি আসলেই অনেক দেরিতে শুরু হয়েছে। এর পেছনে কারণও ছিল অনেক। প্রথমত আমাদের এই ভুখন্ডের যারা কুরআনের ইলমের সাথে সুপরিচিত ছিলেন সেসব কুরআন সাধকদের অনেকেরই কুরআন শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ছিল ভারতের উর্দু প্রদান এলাকার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দেওবন্দ, সাহারানপুর, নদওয়া, জামেঅতুল ইসলাহ, জামেআতুল ফালাহ্সহ উর্দু ভাষাভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এর সবকয়টির ভাষাই ছিল উর্দু কিংবা ফার্সি, তাই স্বাভাবিকভাবেই এসব দ্বীনি প্রতিষ্ঠান থেকে যারা উচ্চ্তর সনদ নিয়ে বের হন তাদের কুরআন গবেষনার পরিমন্ডলও সে ভাষার বাইরে ছড়াতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত পলাশীর ট্রাজেডির ফলে আমাদের এ অঞ্চলে কুরআন গবেষনার কাজটি নানারকম পঙ্গুত্বের কারণে একরকম দেওলিয়া হয়ে পড়েছিল। ফলে বাংলা আসামে কুরআনের আশানুরূপ কোনো অনুবাদই হয়নি। তৃতীয় কারণ হিসেবে বাংলা মুদ্রণ যন্ত্রের কথা উল্লেখ করতে হয়। ১৭৭৭ সালে মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার হলেও এ অঞ্চলের মুসলমানরা ১৮১৫ সালের আগে বাংলা মুদ্রণ যন্ত্রের সাথে পরিচিত হবার কোনো সুযোগই পায়নি।
কে প্রথম কুরআনের বাংলা অনুবাদের সাঅভাগ্যজনক এ কাজটি শুরু করেন, তা নিয়ে আমাদের মাঝে বিভ্রান্তির অন্ত নেই। কে বা কারা আমাদের সমাজে একথাটা চালু করে দিয়েছে যে, ব্রাম্মন ধর্মের নব বিধান মন্ডলীর নিষ্ঠাবান ধর্মপ্রচারক গিরিশ চন্দ্র সেন সর্ব প্রথম কুরআনের বাংলা অনুবাদ করেছেন। আসলে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন সর্বময় আধিপত্য বিরাজমান তারাই যে কথাটা ছড়িয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুঃখ লাগে যখন দেখি আমাদের এ অঞ্চলের দু'একজন কুরআনের মুদ্রাকর ও প্রকাশকও তাদের সাথে সুর মিলিয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ঐতিহাসিকভাবে অসমর্থিত এমনি একটি কথা অবাধে প্রচার করে চলেছেন। অথচ কুরআন ও কুরআনের শিক্ষার প্রতিটি ছাত্রই জানেন যে তার অনুবাদের পাতায় কুরআনের শিক্ষা সৌন্দর্য বাকধারার সাথে ব্রাম্মবাদের প্রচারনিতিতে কুরআনের প্রতি মাহীন বিদ্বেষ ছড়ানো রয়েছে।
গিরিশচন্দ্র সেনের ৬ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৭৯ সালে আরেকজন অমুসলিম রাজেন্দ্রলাল মিত্র কুরআনের প্রথম পারার অনুবাদ করেন। কলকাতার আয়ুর্বেদ প্রেস নামক একটি ছাপাখানা থেকে এক ফর্মার (১৬ পৃষ্ঠা) এই অনুবাদটি ৫০০ কপি ছাপাও হয়েছিল।
১৮৮৫ সালে গিরিশ চন্দ্রসেনের এই অনুবাদের প্রায় ৮০ বছর আগে অর্থাৎ ১৮০৮ সালে পূর্ব বাংলার রংপুর নিবাসী একজন সাধারণ কুরআন কর্মী মওলানা আমিরুদ্দিন বসুনিয়া কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদের কাজে হাত দেন। তিনি সে সময় কুরআনের আমপারার অনুবাদ সম্পন্ন করেন। এই ঐতিহাসিক তথ্যের সমর্থন রয়েছে ঢাকা ও কলকাতার প্রায় সব্কয়জন কুরআন গবেষকের লেখায়। উভয়বাংলার প্রায় সবকয়টি কুরআন গবেষণা সংস্থা, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানই এ বেপারে একমন যে, মওলানা আমিরুদ্দিন বসুনিয়াই সে সোভাগ্যবান মানুষ যেনি বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের এই মহান কাজটির সুচনা করেছেন। গত এক দশকে আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের ইতিহাসের ওপর যে সব পি এইচ ডি থিসিস লেখা হয়েছে তাতেও এ তথ্য সমভাবে সমর্থিত হয়েছে। ১৮১৫ সালে বাংলা মুদ্রণ যন্ত্রের ব্যবহারের পরপর কলকাতার মির্জাপুরের পাঠোয়ার বাগানের অধিবাসী আকবর আলী এ কাজে এগিয়ে আসেন। তিনিও মাওলানা আমিরুদ্দিন বসুনিয়ার মতো শুধু আমপারা ও সুরা ফাতেহার বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। তার অনূদিত অংশটি ছিল পুথির মতো। তার এ অনুবাদটি কুরআনের কোনো মওলিক অনুবাদও ছিলনা। তিনি যেটা করেছেন তা ছিল ১৭৮০ সালে অনুদিত শাহ আব্দুল কাদেরের উর্দু অনুবাদের বাংলা। সরাসরি কুরআনের অনুবাদ নয় বলে সুধী মহলে এটা তেমন একটা স্বীকৃতি লাভ করেনি। আসলে ব্যক্তি যতো গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন তিনি যদি কুরআনকে কুরআন থেকে অনুবাদ না করেন তাহলে তাকে কখনো কুরআনের অনুবাদ বলে চালিয়ে দেয়া উচিত নয়। কুরআনের ব্যাকরণ, বিধি বিশেষ বাকধারা, ভাষা শৈলী, শিল্প সোন্দর্য সর্বপরি কুরআনের 'ফাছাহাত বালাগাত' না জেনে কুরআনের অনুবাদে হাত দেওয়া কারোরই উচিত নয়।
কুরআনের প্রথম অনুবাদক মওলানা আমিরুদ্দিন বসুনিয়া কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করে যেতে পারেননি। পরবর্তী সময়ের গিরিশচন্দ্র সেনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ কর্ম যেটা তখন বাজারে প্রচলিত ছিল তাও ছিল নানা দোষে দুষ্ট, তাই তার অনুবাদের মাত্র ২ বছরের ভেতরই কুরআনের বিশস্ত ও পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ কর্ম নিয়ে হাজির হয়েছেন বিখ্যাত কুরআন গবেষক মাওলানা নাইমুদ্দিন। এর আগে কলকাতার একজন ইংরেজ পাদ্রিও কুরআনের অনুবাদ করেছিলেন। শোনা যায় মাওলানা আমিরুদ্দিন বসুনিয়া থেকে গিরিশচন্দ্র সেন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮০৮ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে আরো ৯ জন ব্যক্তি কুরআন অনুবাদ করেছেন।
বাকি আল্লাহ আলম
{বি:দ্র: লেখায় কোনো প্রকার ভুলত্রুটি থেকে থাকলে পারলে শুদ্রে নিবেন না হলে আমাদের মেইল করবেন ইনশাআল্লাহ আমরা তা অনতিবিলম্বে ঠিক করে দিব।}
আর্টিকেল টি পরা মাত্র শেয়ার করতে ভুল করবেন না মনে রাখবেন আপনার দ্বারা জানিত যদি কেও একটা আমল ও করে তাহলে তার সওয়াব আপনি পাবেন ইনশাআল্লাহ।
আর নিন্মে দেওয়া হাদিস টির কথা মনে রাখবেন সব সময়।
"কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান
সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি
হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]
0 comments: