০১। কুর'আনের সহজ সরল বাাংলা অনুবাদ

   সুরা 'আল ক্বামার' মক্কায় অবতীর্ণ কুর'আনার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুরা। আল্লাহ তা'আলা এই সুরে একটি বিশেষ আয়াত চারবার উল্লেখ করেছেন। সে বিশেষ আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, "অবশ্যই আমি শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যে কুর'আনকে সহজ করে দিয়েছি, অতএব আছে কি তোমাদের মাঝে কেও এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার?"
বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ কুর'আন পাঠকের মতো আমার মনকেও এক সময় এই আয়াতটি দারুনভাবে নাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে যখন দেখি আল্লাহ তা'আলার নাজিল করা আলোর এই একমাত্র উত্সতির ভাষান্তর করতে গিয়ে মানুষরা একে সহজ করার বদলে দিন দিন কঠিন ও দুর্বোধ্য করে ফেলেছে। যে 'আলো' একজন পথিককে আঁধারে পথ দেখাবে তা যদি নিজেই স্বচ্ছ না হয় তাহলে 'আলো' সামনে থাকা সত্তেও পথিক তো আঁধারেই হুচট খেতে থাকবে।
কুর'আন লাওহে মাহ্ফুযের অধিপতি আল্লাহ তা'আলার কালাম, এর ভাষাশৈলী, এর শিল্প সোন্দর্য সবই আল্লাহ তা'আলার একান্ত নিজস্ব। এ  কারণেই বিশ্বের সব কুর'আন গবেষকই মনে করেন, এই মহান গ্রন্থর যথার্থ ভাষান্তর কিংবা এর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ কোনটাই মানব সন্তানের পক্ষে সম্বব নয়। যার কাছে এই বিস্ময়কর গ্রন্থটি নাজিল করা হযেছিল তাঁকে আল্লাহ তা'আলা স্বয়ং এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বলেই তার পক্ষে এই কিতাবের মর্মোদ্ধার করা সম্ববপর হযেছিল। এমনকি কুর'আন যাদের সর্বপ্রথম সম্বোধন করেছিল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম এর সে সাহাবীরাও কুর'আনের কোনো বক্তব্য অনুধাবনের বেপারে মতামত দেওয়ার আগে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করে নিতেন। যদিও তারা নিজেরা সে ভাষায়ই কথা বলতেন, যে ভাষায় কুর'আন নাজিল হযেছিল। সম্ভবত এ কারণেই সাহাবায়ে কেরামদের বিদায়ের বহুকাল পর ও ভিন্ন ভাষাভাষী কুর'আনের আলেমরা কুর'আনের অনুবাদ কাজে হাত দিতে সাহস করেননি, কিন্তু দিনে দিনে কুর'আনের আলো যখন আরব উপদ্বীপ ছাড়িয়ে অনারব জনপদে ছড়িয়ে পড়ল, তখন কুর'আনের প্রয়জনে তথা ভিন্ন ভাষাভাষীদের সামনে কুর'আনের বক্তব্য তুলে ধরার জন্যে স্থানীয় জনগোষ্টির ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকলোনা। এমনি করেই অসংখ আদম সন্তানের অগনিত ভাষায় কুর'আন অনুবাদের যে স্রোতধারা শুরু হলো, আমাদের মায়ের ভাষা বাংলায় ও একদিন এর প্রভাব পড়ল। কুর'আনের পন্ডিত বেক্তিরা একে একে এগিয়ে এলেন নিজেদের স্ব-স্ব জ্ঞান গরিমার নির্যাস দিয়ে এই অনুবাদ শিল্পকে সাজিয়ে দিতে।
একথা স্বীকার করতেই হবে যে, উপমহাদেশের মুসলিম জনগুষ্টির শত শত বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভাষা হিসেবে আরবীর পরেই ছিল ফার্সি ও উর্দুর স্থান। স্বাভাবিকভাবেই কুর'আন অনুবাদের কাজ ও তাই এ দুটু ভাষায়ই বেশি হযেছে। সুলতানি আমলের শুরু থেকে মুসলমান শাসক নবাবরা যখন সংস্কৃত ভাষায় সীমিত গন্ডি থেকে বাংলা ভাষাকে বৃহত্তর জনগোষ্টির পরিমন্ডলে নিয়ে এলেন, তখন থেকেই ধীরে ধীরে এই ভুখন্ডে কুর'আনের বাংলা অনুবাদের প্রয়জন ও অনুভূত হতে লাগলো।
৪৭ ও ৭১ সালের পরপর দুটো পরিবর্তনের ফলে এ ভুখন্ডের মুসলমানরা নিজেদের ভাষায় কুর'আনকে বুঝার একটা ব্যাপক পরিসরে পা রাখার সুযোগ পেলো। অল্প কিছুদিনের মাঝেই কুর'আনের বেশ কযেকটি অনুবাদ বেরিয়ে গেল। নিতান্তই সীমিত পরিসরে হলেও আমাদের পশ্চিম বাংলার মুসলমানরাও এ সময়ের মধ্যে কুর'আনের কযেকটি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। অবস্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুবাদক ও প্রকাশকরা তাদের অনুবাদ্কর্মকে কুর'আনের বাংলা অনুবাদ না বলে 'বাংলা কুর'আন শরীফ' বলে পেশ করার প্রয়াস চালিয়েছেন। আমাদের এই বাংলায়ও কিন্তু ইদানিং কুর'আনের বাংলা অনুবাদ গ্রন্থের গায়ে 'বাংলা কুর'আন শরীফ' লেখার একটা অসুস্থ মানসিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সমাজের দু'একজনের এই অগ্গাতপ্রসুত প্রয়াস সত্বেও মুসলমানদের বৃহত্তর জনগোষ্টির লোকেরা এগুলোকে কুর'আনের বাংলা অনুবাদ বলেই গ্রহণ করেছে। এই বিষয়টিকে বাদ দিলে আমাদের দেশে অনূদিত ও প্রকাশিত কুর'আনের প্রতিটি গ্রন্থই নানা বৈশিষ্টে বৈশিষ্টমন্ডিত। আল্লাহ তা'আলার কিতাবের মর্মকথা মানুষের কাছে পৌছানোর কাজে যে যতটুকু অবদান রেখেছেন আল্লাহ তা'আলা তাদের সবাইকে সে পরিমান 'জাজায়ে খায়ের' দান করুন।
কুর'আন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাঁর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম) এর কাছে পাঠানো তাঁর বাণীসমূহের এক অপূর্ব সমাহার। সুদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বিপ্লবের সিপাহসালারকে তাঁর মালিক যে সব দিক নির্দেশনা দিয়েছেন তার অধিকাংশই বলতে গেলে পারিপার্শিকতার বিশ্লেষণ তথা এক একটি ঐতিহাসিক পটভুমির সাথে জড়িত। এ কারণেই কুর'আনের তাফসিরকাররা কুর'আন অধ্যায়নের জন্যে সমসামিক পরিস্থিতি জানার ওপর এত বেশি জোর দেন।

তারপরও কুর'আনের মূল অনুবাদ কিন্তু কুর'আন পাঠকের কাছে জটিলই থেকে যায়। অনেক সময় মূল কুর'আনের আয়াতের হুবহু বাংলা অনুবাদ করলে কুর'আনের বক্তব্য মোটেই পরিষ্কার হয়না। সেক্ষেত্রে কুর'আনের একজন নিষ্ঠাবান অনুবাদককে অনুবাদের সাথে ভেতরের উহ্য কথাটি জুড়ে দিয়ে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা মিলিয়ে দিতে হয়। আরবি ভাষার ব্যাকরণ ও বাক্য গঠন প্রক্রিয়ায় এগুলুর প্রচলন থাকলেও বাংলা ভাষায় এ বিষয়গুলো কুর'আনের পাঠককে মাঝে মাঝে দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেলে। তারা হেদায়াতের এই মহান গ্রন্থে এসব অসংলগ্নতা দেখে বর্ণনাধারার 'মিসিং লিংক' খোঁজার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ কারণেই সচেতন অনুবাদকরা এ সব ক্ষেত্রে নিজের কথার জন্যে 'ব্রাকেট' কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ধরনের টাইপ বাবহার করে সেই মিসিং লিংকটাকে মিলিয়ে দেন। আমাদের মধ্যে যারা 'তাফসীরে জালালাইন' পড়েছেন তারা সেখানে এ বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য করে থাকবেন। এই তাফসীরে বিজ্ঞ তাফসীরকাররা তাদের নিজেদের কথাকে 'আন্ডার লাইন' করে আল্লাহ তা'আলার কথা থেকে আলাদা করে নিয়েছেন। কোরআনে অ ধরনের বহু আয়াত রয়েছে, এখানে উদাহরণ হিসেবে সুরা 'আল মায়েদা' ৬, সুরা ইউসুফ ১৯, সুরা 'আর রাদ' ৩১, সুরা 'আয যুমার' ২২, সুরা 'কাফ' ৩ এই আয়াত্গুলুর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ আয়াত গুলুর অনুবাদের প্রতি তাকালে একজন পাঠক নিজেই এ বিষয়টি বুজতে পারবেন, কি ধরনের ধারাবাহিকতার কথা আমি এখানে বলতে চেয়েছি। আমাদের এই গ্রন্থে অনুবাদের সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্যে আমরা আল্লাহ তা'আলার কথা থেকে নিজেদের কথা আলাদা করার জন্যে এ ধরনের () 'ব্রাকেট' বাবহার করেছি। কুরআনের মালিককে হাজির নাজির জেনে আমরা যেমন চেষ্টা করেছি ব্রাকেটের ভেতর আল্লাহ তা'আলার কথা না ঢুকাতে তেমনি চেষ্টা করেছি ব্রাকেটের বাইরে অনুবাদকের কথা না ছড়াতে। তারপরও যদি কোথাও তেমন কিছু ভুল ত্রুটি থেকে যায় তা আগামীতে শুদ্ধ করে নেআর কঠিন প্রতিজ্ঞার পাশাপাশি আমার মালিককে বিনীত চিত্তে বলবো, হে আল্লাহ, তুমি আমার ভেতর বাইর সবটার খবরই রাখো, আমার নিষ্ঠার প্রতি দয়া দেখিয়ে তুমি আমার সীমাবদ্ধতা মাফ করে দিও।


অনুবাদক: হাফেজ মুনির উদ্দিন আহমদ
লন্ডন, ১ মহররম ১৪২৩ হিজরী 
১৫ই মার্চ ২০০২ মূ 



{ব্লগারের বি:দ্র: লেখায় কোনো প্রকার ভুল থেকে থাকলে ক্ষমা চুখে দেখবেন অথবা আমাদের মেইল করবেন আমরা তা শুদ্রে নিব, আর কুরআনের এই অনুবাদ গ্রন্থটি পেতে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন।

পোষ্টটি শেয়ার করে অন্যে জানার সুযুগ করে দিন মনে রাখবেন নিন্মের হাদিসটি।

"কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান

সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি 

হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪] 

0 comments: